এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের কবিতার একটি লাইন ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ আজও হাজার হাজার বাঙালীর সন্তান যারা বস্তির অধিবাসী, টোকায়, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগার করতে পারে না- তাদের কাছে ঝলসানো রুটিকে আকাশের পূর্ণিমা চাঁদের মতোই আরাধ্য লাগে।
রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের তিন দিন পরও আর্তনাত থামছে না ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের। সর্বস্বান্ত ব্যবসায়ীদের অনেকেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। এরই মধ্যে আগুন নেভানোর কর্মীদের সাথে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপরাধে ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে চলছে নানা নির্যাতন। মুসলমানেরা রোজা রাখছেন। অল রাউন্ডার ক্রিকেটার সাকিবের কুড়িহাজার টাকা অনুদান নিয়েও চলছে নানা মুখোরোচক গল্প।
পাঠক! এবার একটি গল্প দিয়েই লেখাটি শুরু করতে চাই। হজরত ওমর (রা) একবার অসুস্থ হয়ে টাটকা মাছ খাওয়ার বাসনা হল। মদীনায় অনেক খোঁজাখোঁজির পর তা পাওয়া গেল না। কয়েকদিন পর যখন পাওয়া গেল তখন দেড় দিরহাম দিয়ে কিনে এনে রান্না করা হল। তারপর একটা রুটির উপর মাছটা রেখে হজরত ওমর (রা) এর সামনে পেশ করা হল। ঠিক এই সময় এক ভিক্ষুক দরজায় এসে হাক দিল। হজরত ওমর (রা) বললেন- এই মাছ উক্ত ফকিরের জন্য দিয়ে দাও। খাদেম আরজ করল জনাব অনেক দিন থেকে যখন মাছ খেতে আপনার মন চাইছিল, তখন তা পাওয়া যায় নাই, এখন পাওয়ার পর দেড় দিরহাম দিয়ে কিনে এন আপনার জন্য রান্না করেছি। আপনি বললে আমি ভিক্ষুককে এর মূল্য দিয়ে দেই। তিনি বললেন না, এই মাছ রুটির সাথে জড়িয়ে তাকে দিয়ে দাও, অতঃপর খাদেম ভিক্ষুককে বলল-তুমি এটা এক দিড়হামের বিনিময়ে বিক্রি করবে? ভিক্ষুক সম্মতি দিলে খাদেম এক দিরহামের বিনিময়ে তাকে দিয়ে আবার তার সামনে হাজির করল এবং বলল এ মাছটি আপনার জন্য এক দিরহাম দিয়ে কিনে এনেছি। হজরত ওমর (রা) আবার বলল- ভিক্ষুকের কাছ থেকে দেরহাম ফিরত না নিয়ে এই মাছ সহ রুটি টা তাকে দিয়ে এসো।
একবার মুসলমানরা গণিমতের মাল হিসাবে কিছু ইয়ামানী কাপড় পেয়েছিলেন। সকলকে এক টুকরো করে কাপড় বন্টন করে দেওয়া হল। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সেই কাপড় দিয়ে জামা তৈরি করলেন। তিনি যেহেতু লম্বা-চওড়া ছিলেন, এক টুকরো কাপড়ে তাঁর জামা হতো না, তাই তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ নিজের কাপড়টিও তাঁকে দিয়ে দিয়েছিলেন। মিম্বরে উঠে খুতবা দেওয়ার সময় একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে বলল: আপনি যে জামা পরেছেন, তা এক টুকরো কাপড়ে বানানো সম্ভব নয়। এর উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত আমরা আপনার খুতবা শুনব না। যখন আব্দুল্লাহ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন যে তিনি তাঁর ভাগের কাপড়টিও পিতাকে দিয়ে দিয়েছেন জামা বানানোর জন্য, তখন লোকটি মেনে নিল।
এবার আমি হক কথা বলার একটি বিনম্র উদাহরণ পেশ করে লেখাটি শেষ করব।। ভারতে তখন খিলজী বংশের শাসন চলছে। রাজা আলাউদ্দিন খিলজী সিংহাসনে। নিষ্ঠুরতার জন্য তিনি কুখ্যাত ছিলেন। তার সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল অজ্ঞানতা। তিনি একদিকে ছিলেন অক্ষরজ্ঞানহীন। আবার অন্যদিকে জেদী। ফলে বিভিন্ন আমীর-ওমরা, উজির-নাজির সবাই রাজাকে ভয় করতেন যমের মতো। রাজার সামনে দাঁড়িয়ে তারা থরথর করে কাঁপতেন। রাষ্ট্রে তখন শরীয়া আইন প্রচলিত। তাকে সার্বিক সহযোগিতার জন্য প্রধান বিচারপতি বা কাজী উল কুম্মাত সর্বদা দরবারে উপস্থিত থাকতেন এবং প্রয়োজনীয় আইনের ব্যাখ্যা দিতেন। একদিন একটি বিব্রতকর বিষয় নিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি চলছিল। রাজা স্পষ্টতই অন্যায়ভাবে একজনের পক্ষ অবলম্বন করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু এর জন্যে দরকার ছিল প্রধান কাজীর নিকট থেকে প্রয়োজনীয় কোরআনের আইনি ব্যাখ্যা। রাজা কাজীকে জিজ্ঞাসা করলেন এবং মনে মনে আশা করলেন যে, কাজী রাজার পছন্দমতো আইনের ব্যাখ্যা দেবেন। কাজী দাঁড়িয়ে রাজাকে কুর্নিশ করলেন এবং বিমর্ষ বদনে বললেন, ‘হুজুর আমার মনে হচ্ছে মৃত্যু আমার গর্দানের ওপর ভর করেছে। নচেৎ মহান রাজা আমাকে এমন প্রশ্ন কেন করবেন।’ কাজীর এই উত্তরে রাজা হেসে দিলেন এবং বললেন, কেন আপনার মৃত্যুর কথা মনে হলো। কাজীর উত্তর, ‘আমি যদি সত্য বলি তবে হুজুর রাগ করবেন। অন্যদিকে মিথ্যা বললে আল্লাহ রাগ করবেন। আমি হুজুরের এজাজত চাচ্ছি-কোনটি আমার করণীয়।’ বিচক্ষণ রাজা সহাস্য বদনে কাজীকে সত্য কথাটি বলার নির্দেশ দিলেন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন বিশ্লেষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮